গল্পঃ--- আমার নেশা তুমি
লেখিকাঃ-- Sabriha Sadi (সাদিয়া)
পর্ব : ১০
আনিসা পিট পিট করে তাকায়। শরীর মুচড়ে বিছানায় উঠে বসল। শরীর টা এখন আর তেমন ক্রান্ত লাগছে না। তবে মাথাটা ভারভার লাগছে অনেক টা।
আনিসা হাই তুলতে তুলতে উঠে দাঁড়ায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৮ টা ১৪ বাজে। এটা রাত নাকি সকাল তা মনে পরছে না আনিসার।
সে চোখ ডলতে ডলতে বিছানা ছেড়ে এগিয়ে আসে।
কারো গোঙানোর আওয়াজ ভেসে আসছে আনিসার কানে।
সোফায় দেখতে পায় শ্রেয়ান সোফায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে কাঁপছে। এত বেশি কাঁপার ফলে গলা দিয়ে গোঙানোর আওয়াজ হচ্ছে। আনিসা ভয় পেয়ে যায়। এগিয়ে আসে শ্রেয়ানের দিকে।
সোফার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে ডাক দেয়,
"শুনছেন?"
"....
"এই যে শুনছেন?"
"....
শ্রেয়ানের সাড়া না পেয়ে আনিসার তাকে ধাক্কা দিতে হাত বাড়ায়। সাথে সাথে আনিসা ভয়ে কেঁপে উঠে। শরীর অত্যধিক পরিমাণ গরম। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। আনিসা এখন বুঝতে পারছে না কি করবে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। শ্রেয়ানের শরীর ধরে ধাক্কা দেয়। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। শ্রেয়ান শুধু কাঁপছে। এবার আনিসা আরো ভয় পায়। দিশেহারা আনিসার মাথায় কিছুই আসছে না কি করা যায়।
বিশাল দেহী শ্রেয়ান কে টেনে নেওয়া আনিসার পক্ষে অসম্ভব।
শ্রেয়ান কে ডাকে। তার হাত টেনে ধরে। কোনো রকম উঠে বসায়। শ্রেয়ান মাথা হেলিয়ে দেয় আনিসার ঘাড়ে।
"শুনছেন? এই যে শুনছেন? আপনায় বলছি।"
"....
কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর শ্রেয়ান চোখ খুলে তাকায়। হেলে ডুলে পরা চোখের পাতা দিয়ে শ্রেয়ান আনিসার দিকে তাকায়।
"শুনছেন? আপনি একটু উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন দয়া করে। আপনায় বিছানায় নিয়ে যাই।"
আনিসার কাঁধে মাথা রেখে শ্রেয়ান কাঁপা হাতে আনিসা কে ছুঁতে চায়। আনিসা সেই হাত ধরে শ্রেয়ান কে উঠে দাঁড় করাল। দুই হাতে সব শক্তি দিয়ে আনিসা বিছানার কাছে নিয়ে যায় শ্রেয়ান কে। কিন্তু আর পারে না। শক্তির সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে আনিসা বিছানায় শ্রেয়ানের উপর পরে গেল। শ্রেয়ান কে শুয়িয়ে দিলে নিজের উপর আর ভার রাখতে সক্ষম হয় নি আনিসা। ফলে শ্রেয়ানের উপর হিচড়ে পরে।
শ্রেয়ান আবারও আধো আধো চোখে আনিসার দিকে তাকাল। আনিসা উঠতে চায়। শ্রেয়ান তার ডান হাত আনিসার উপর তুলে ফেলে। আবার মিনমিনিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।
শ্রেয়ান কাঁপছে। তার হাল্কা লাল আভা ঠোঁট কাঁপছে। শ্রেয়ানের অতিরিক্ত উষ্ণ শরীরে আনিসার শরীর গরম হয়ে আসল।
আনিসা থরফরিয়ে উঠে। শ্রেয়ান কে ঠিক করে শুয়িয়ে দেয়। শরীরের উপর কম্বলও টেনে দিল। শরীরের গরম আভা পেয়ে শ্রেয়ান আরো কাঁপতে থাকে।
এত সময় শ্রেয়ান পানিতে ভিজে ছিল নিজেকে ঠান্ডা করতে। এখন বিপত্তি হলো। শরীর কাঁপনি জ্বর এলো শরীরে।
আনিসা বুঝতেই পারছে না কি করবে। তার মনে পরে তার যখন জ্বর হতো তার মা তার উপর লেপ কম্বল দিয়ে জড়িয়ে রাখত। তাতে নাকি উম বাড়ে। আনিসা অস্বস্তি বোধ করলেও এ ছাড়া কোনো উপায় পাচ্ছে না। শ্রেয়ানের ধরফড়িয়ে কাঁপনি দেখে আনিসার মায়া লাগছে। যে মানুষ টা তাকে নরম থেকে রাজপ্রসাদে আনল। অথচ এখনো কোনো অপ্রস্তুতিকর কোনো ঘটনা ঘঠায় নি। যা সব কিছুর জন্যে আনিসা প্রস্তুত ছিল। কারণ এ ছাড়া কোনো কারণ আনিসার জানা নেই যার জন্যে একটা সুদর্শনে এত বড়লোক পুরুষ তার মতো কুমারী মেয়ে কে কিনবে বলে। কিন্তু তার সাথে এমন কিছুই করেনি লোক টা। আর সেই লোক টা...
আনিসা আর সময় নষ্ট করেনি। দ্বিধাদ্বন্দ্ব রেখে সে শ্রেয়ানের দিকে এগিয়ে যায়।
শ্রেয়ানের কম্বলের উপর আনিসা তাকে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়ান থরথর করে কাঁপছে। শ্রেয়ানের কাঁপনি তে আনিসাও যেন কেঁপে উঠে। আনিসা আরো শক্তে শ্রেয়ান কে জড়িয়ে ধরল।
প্রায় ঘন্টা খানেক আনিসা শ্রেয়ানের উপরে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ছিল।
এখন শ্রেয়ান একটু ঠিক হয়েছে। তার শরীরের কাঁপনি বন্ধ হয়ে আছে। উম পেয়ে শ্রেয়ান স্থির হয়ে শুয়ে আছে। শুয়ে আছে বলতে ঘুমিয়ে আছে।
আনিসা উঠল। শ্রেয়ানের কপালে হাত রাখল। কাঁপনি বন্ধ হলেও জ্বর কমেনি। আনিসা কিছু চিন্তা করে তাড়াতাড়ি নিচে যায়। বড় একটা বাটি তে নরমাল পানি আর একটা কাপড়ের টুকরো নিয়ে আবার শ্রেয়ানের কাছে দৌড় দিল। জলপট্টি দিতে থাকে। রাত তখন ১০ টা বাজে। আনিসা জলপট্টি দিতে ব্যস্ত। এতক্ষণ ঘুমানোর কারণে এখন তার ঘুম আসছে না।
আনিসা ঘড়ির দিকে তাকায়। ১২ টা ৫০ বাজে। এতক্ষণ শুধু শ্রেয়ান কে জলপট্টি দিয়েছে।
আনিসা আবার শ্রেয়ানের কপালে হাত রাখে। জ্বর টা এখন অনেক কমে গেছে। স্বাভাবিক গরম লাগছে। আনিসা ঔষধের বক্স কোথায় আছে কিছুই জানে না। বাড়িতে কেউ নেই যে ডাক্তার আনবে। তাই আনিসা প্রাথমিক চেষ্টাটুকই করল।
আনিসার চোখের সামনে ভাসছে কদিন আগের কথা। শ্রেয়ান তার চিবুক তুলে কপালের আঘাত টা দেখছিল। স্পষ্ট সেই স্পর্শ এখনো মনে আছে ওর। তার জীবনে সেই প্রথম কোনো পুরুষের ছুঁয়া পেয়েছিল। শ্রেয়ান বেশ আলতো আর দক্ষতার সাথে সেদিন তার কপাল টায় মলম আর ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল।
ভেবেই আনিসা একগাল হেসে উঠে। শ্রেয়ানের দিকে তাকায়। ঘোর লাগানো দৃষ্টি দিয়ে তাকায়।
আরো ঘন্টা খানেক পর আনিসার চোখ লেগে আসতে থাকে। অনেক ঘুম পেয়েছে তার। চোখ খুলতে পারছে না। কটা বাজে বা শ্রেয়ানের জ্বরের তাপ কতটুক তা দেখার বা বুঝার সময় আনিসার ছিল না। চোখ আঠার মতো লেগে আসছে ঘুমে।
সকালের মিষ্টি রোদ্দুরের ঝিলিক পরছিল কাঁচের দেওয়াল দিয়ে। সেই রোদের ঝিলিক শ্রেয়ানের উপর পরতেই পিনপিন করে তাকায়।
শরীর ম্যাচম্যাচ করছে। বেশ ভারও লাগছে। শ্রেয়ান ভালো করে তাকায়। সকালের মিষ্টি রোদের আভা দেখতে থাকে।
শ্রেয়ান পাশ ফিরতে গেলে দেখতে পায় এক রোদপরী কে। দুধে আলতা গায়ে রোদের ঝিলিক পরে আগুন সুন্দরী লাগছে আনিসা কে। আনিসা তার কম্বলের উপর গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে রূপ কথার রাজ্যের ঘুম কুমারীর ন্যায়। এতো আনিসা নয় এক মনোরম আগুনের দলা। সামনের চুল এলোমেলো হয়ে আছে। চিকন ঠোঁট গুলির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ বুজা ঘন কালো চোখের পাঁপড়ি গুলির থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছা করছে না শ্রেয়ানের।
শ্রেয়ান মোহ নিয়ে দেখতে লাগল।
"আমার নেশা তুমি কুমারী। তোমার নেশায় পড়ে আমি উন্মাদ। কুমারীর নেশায় পড়ে শ্রেয়ান চৌধুরী ভুল কিছু করে নি। আনিসা সত্যিই #আমার_নেশা_তুমি।"
শ্রেয়ান বিড়বিড় করে কথা গুলি বলে। পাশ ফিরে আনিসার মুখের দিকে নেশা ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রয়।
শ্রেয়ানের বুকের ভেতর আবার ঝড় হতে থাকে। এই পিচ্ছি আনিসার সামনে এসে তার দিকে গভীর দৃষ্টি দিলেই শ্রেয়ানের ভেতরে তুফান হয় তুফান। শ্রেয়ানের পৃথিবী টা তোলপাড় হওয়া শুরু করে। ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে যাচ্ছে তার বুকের ভেতর।
এক প্রবল নেশা ধরে গেছে শ্রেয়ানের। আনিসার ওই মোহনীয় আগুন সুন্দরের দিকে নেশা ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থেকে শ্রেয়ানের এক শক্ত কড়া নেশার জন্ম হয়েছে। এই নেশা আনিসা কে চাইছে। আগুন সুন্দরী আনিসা কে বড্ড টানছে শ্রেয়ানের কড়া নেশা। শ্রেয়ান বেশ বুঝতে পারছে তার ভেতরে কি চলছে। এটাও বুঝতে পারছে তার মাতাল মন কি চাইছে এই মুহূর্তে। শ্রেয়ান পারছেও না নিজেকে সামলাতে। না পারছে ভুল কিছু একটা করে ফেলতে। ভেতরের আরেকটা "শ্রেয়ান" জাগ্রত হয়ে উঠছে শ্রেয়ানের।
শ্রেয়ান প্রবল মোহ নিয়ে আনিসার দিকে হাত বাড়ায়। নিজেকেও আনিসার দিকে এগিয়ে নিতে লাগল।
আনিসার গরম নিশ্বাস যেন শ্রেয়ান কে আরো পাগল করে তুলছে। উন্মাদ থেকে উন্মাদ করে তুলছে সেই উষ্ণ নিশ্বাস। সেই নিশ্বাস শ্রেয়ানের কড়া নেশা কে যেন আরো প্রবল করে তুলছে।
শ্রেয়ানের কড়া নেশা হিমালয় ছুঁয়েছে। বিশাল এক বালিঝড় হয়ে ধেয়ে আসছে। আনিসার গরম নিশ্বাস শ্রেয়ানের মস্তিষ্ক কে বিকৃত করে তুলে থাকে।
শ্রেয়ান চোখ বন্ধ করে আনিসার খুব কাছে চলে গিয়েছে। অনেক টা কাছে। হঠাৎ যেন শ্রেয়ানের বিবেক তার কানে কানে বলে গেল, "শ্রেয়ান ভুল করছো তুমি। না শ্রেয়ান এটা মুটেও ঠিক না। ভুল করছো তুমি শ্রেয়ান।"
শ্রেয়ান ধক করে চোখ মেলে ফেলে। আনিসা কে নিজের খুব কাছে আবিষ্কার করে তখন।
শ্রেয়ান হুড়মুড়িয়ে কম্বল টেনে আনিসার থেকে দূরে চলে গেল।
নাড়া পেয়ে আনিসা জেগে উঠে। চোখ ডলে শ্রেয়ানের দিকে তাকাল। শ্রেয়ানের চোখ মুখ দেখে সে অবাকই হয়।
"আপনি.."
"তুমি এখানে কি করছো?"
"....
আনিসা হা হয়ে তাকিয়ে আছে। লোকটার কি মনে নেই তার জ্বর হয়ে ছিল রাতে?
শ্রেয়ান কম্বল রেখে বিছানা ছেড়ে উঠে।
"তুমি কি এখানে সারা রাত ছিলে?"
"....
আনিসা বুঝতে পারে লোকটার মনে নেই রাতের কথা।
"কি হলো? আমি তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করছি তো?"
"আপনার জ্বর কমেছে?"
"জ্বর?"
"আপনার জ্বর না হলে কি আমি আপনার রুমে থাকতাম নাকি? ওই দেখুন জলপট্টি আর পানির বাটি।"
আনিসার হাত দেখানো অনুসর করে শ্রেয়ান বাটি তে পানির মাঝে রাখা জলপট্টি দেখল।
তার মনে পরে কাল রাতের কথা। আনিসা কান্না করে অজ্ঞান হওয়ার পর সে নিজের রাগ থামাতে শাওয়ার নিচ্ছিল। খুব সময় নিয়ে। তার পরেই শরীর কাঁপছিল। সোফায় শুয়ে পরেছিল কাঁপনির কারণে। তারপর তো তার আর কিছুই মনে পারছে না।
"তুমি এখন যাও।"
"কিন্তু আপনার জ্বর.."
"আনিসা আমি তোমায় যেতে বলছি। যাও এখন। নাও গো।"
শ্রেয়ানের ধমক শুনে আনিসা অবাক হয়ে গেল। সাথে ভয়ও পায়। আনিসা শ্রেয়ানের দিকে একবার নজর দিয়ে মৃদু পায়ে রুম থেকে চলে যায়।
শ্রেয়ান বুক ফাটানো এক লম্বা নিশ্বাস নেয়। জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।
টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে গরগর করে সব টা পানি শুষে নিল।
নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত কষে শ্রেয়ান একাই বলতে থাকে,
"আনিসা তোমায় দেখলে আমি কেন ঠিক থাকতে পারি না? তোমার সামনে আসলে কেন নিজেকে সামলে রাখতে পারি না আমি? কেন আনিসা কেন?"
চলবে....


