গল্পঃ--- আমার নেশা তুমি
লেখিকাঃ-- Sabriha Sadi (সাদিয়া)
পর্ব : ১১
"পুরুষ মানবরা রঙ বদলাতে সময় নেয় না। তাদের আকাশে কখন কোন রঙ দেখা দেয় মনে হয় তারাও সেটা জানে না। মনে হলো করে ফেলল। এমন একটা কিছু পুরুষের মাঝেই বেশি দেখা দেয়।"
শ্রেয়ান ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছে শেষ করছে তো আবার নতুন আরেকটায় আগুনের ছুঁয়া দিচ্ছে।
আজ ড্রিংক করতে শ্রেয়ানের ইচ্ছা হচ্ছে না। সিগারেটের মাঝেই তার ঝুঁক লাগছে বেশি। সিগারেটের আগুনে নিজের মন টাও পুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। বেটা বেসামাল মন নিজের আবদ্ধে থাকতে চায় না। আনিসার সামনে গিয়ে সে একটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে দেখতেও পারে না। তার আগেই বেসামাল মন নেঁচে উঠে প্রজাপতির মতো। মনে রঙিন হাজারো প্রজাপতি নাচতে থাকে। অনেক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে তার কাছে।
বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
"শালা বেসামাল মন। নিজের সীমায় থাকতে পারিস না? যখন তখন তোর ঘুম থেকে জেগে উঠতে হয় কেন? ততক্ষণেই ঘুমিয়ে থাকিস যতক্ষণ আনিসা আমার সামনে থাকে না। যখনি দেখবি আনিসা সামনে এসেছে? তোর মরার ঘুম ছেড়ে উঠে পরবি। আমার ভেতরের দরজায় টুকা দিয়ে কত কথা বলবি। নিজের সীমা অতিক্রম করা ইচ্ছা গুলি আমার মাঝে চাপিয়ে দিস। তোর কারণে আনিসা কে মন মতো একটু দেখতেও পারি না।
বেটা মন তোকে আমি..."
শ্রেয়ানের বিড়বিড় করে কথা শেষ হওয়ার আগেই সে অনুভব করে কেউ তার পিছনে।
শ্রেয়ান চুপ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
পড়ন্ত বিকেলের পরিবেশটা বেশ লাগছে। শ্রেয়ান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান বসাচ্ছে। কারণ সে জানে তার পেছনে আনিসা ই দাঁড়িয়ে আছে।
"উমম। বলছিলাম....
"কিছুই বলোনি।"
শ্রেয়ান আগের মতোই আনিসার পিছল হয়ে দাঁড়িয়ে জবাব দেয়। আনিসা চুপ করে থাকে।
সকালের পর আনিসা তেমন শ্রেয়ানের সামনে আসেনি। একটু অভিমান হয়েছে বৈকি। হবে না? তখন শ্রেয়ান কি করল তার সাথে? রাত জেগে সে সেবা করল উল্টো শ্রেয়ান তাকে ধমকিয়ে নিজের ঘর থেকে বের করে দিল। আনিসা নিচের একটা রুমে সারা দিন ছিল। শ্রেয়ান সারা দিনেও একটি বার তাকে ডাকল না। কথাও বলল না। অনেক অভিমান হয়েছে আনিসার। কিন্তু তা সে প্রকাশ করতে চাইছে না। করবেই কেন? সে তো শ্রেয়ানের কেউ নয়।
জ্বরের কারণে শ্রেয়ান আজ বাসায় ছিল। অবশ্য কোনো দরকার ছাড়া আর তার মন না বলা ছাড়া সে অফিস যায় না। ছোটবেলার বন্ধুই সব সামলে নেয়।
শ্রেয়ান ইচ্ছা করেই আজ আনিসার সামনে যায় নি। চায়ওনি আজ সারাদিনে আনিসা তার সামনে আসুক।
শ্রেয়ান তার বেসামাল মন কে একটু শাসন করতে চেয়েছে আজ। সে কেন শ্রেয়ানের কথা শুনে না? শ্রেয়ান না চাইলেও কেন সেই মাতাল মন ঘুম থেকে জেগে উঠে? আজ একটু শিকল দিয়ে বাঁধতে চেয়েছিল মন কে।
সকালের জন্যে শ্রেয়ান নিজের উপরেই রেগে আছে।
আনিসা অভিমান করে বসে থাকত না। কিন্তু তবুও সামনে আসত না। নিহাত জ্বরের খবর টা না জেনে তার অস্থির লাগছিল। কেন লাগছিল তা জানে না।
নীরবতা রেখে আনিসা শান্ত কন্ঠে বলল,
"বলছিলাম কি আপনার জ্বর টা..
"ভালো। আই এম ফাইন।"
".....
"জ্বর কমেছে। এত চিন্তা করতে হবে না।"
".....
"ধন্যবাদ।"
আনিসা ভ্রু কুঁচকে বলে,
"কেন? আমাকে ধন্যবাদ.."
আনিসার কথা শেষ হওয়ার আগেই শ্রেয়ান ঠিক আগের মতোই আনিসার দিকে না ফিরে বলল,
"রাত জেগে আমায় সেবা করার জন্যে।"
আনিসা এই কথা শুনে তাচ্ছিল্য একটা হাসি দিয়ে বলল,
"আমায় আবার ধন্যবাদ? আপনি আমায় দয়া না করলে এই সব কিছু হতই না।"
শ্রেয়ান বুঝতে পারে কথার মানে। সে মুখ ফিরেই থাকে। কিছু বলে না।
"আচ্ছা বলুন না আমায় কেন এত টাকা দিয়ে কিনে আনলেন?"
শ্রেয়ানের মুখ থেকে শুনা গেল।
"দূর কিসের সিগারেট বানায় খেয়ে শান্তি পাওয়া যায় না। একটুও ভালো না। আরো কড়া ব্যন্ডের আনতে হবে।"
শ্রেয়ান চিৎকার করে এই কথা ফলে ছাদ থেকে সিগারেট টা ফেলে দেয়। প্যাকেট টাও ছুড়ে ফেলে দিল। আনিসা বুঝেতে পারে শ্রেয়ান রেগে গিয়েছে। আগেও তাকে বলেছিল এই কথা যেন মুখে উচ্চারণ না করে। আনিসা আগ্রহ বশত বলে ফেলল। আনিসা বুঝতে পারে এই সব উনাকে বলে লাভ নেই। কিছুই বলবে না।
আনিসা বুক ফাঁটা নিশ্বাস নিয়ে সেখান থেকে চলে আসার জন্যে পা বাড়ায়।
শ্রেয়ান এক টান দিয়ে আনিসা কে এনে ঘুরিয়ে ছাদের রেলিং এর সাথে চেঁপে ধরে। আনিসার দুই বাহু শক্ত করে ধরে রেখেছে। চোখ লাল। দাঁতে দাঁত কষছে। আনিসা ভয়ার্ত চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
শ্রেয়ান আনিসার গাল চেঁপে ধরে। কটমট করে বলে,
"মেয়ে একবার না দুই বার না অনেক বার বলেছি এক কথা দুই বার বলাবে না শ্রেয়ান কে দিয়ে। কিন্তু তুই? আগেও মানা করেছি না এই কথা বলতে? কেন বলেছিস? বারবার কেন বলিস কিনার কথা? মেয়ে যে ভাবে এনেছি সেই ভাবেই এই ছাদ থেকে ফেলে দিতে পারি। পিচ্চি আবারও বলছি আমার রাগ উঠাস না।"
শ্রেয়ান দম নেয়। আনিসা অনেক ভয় পায়। সাথে খুব অবাকও। লোক টা কি পাগল? বদ্দ উন্মাদ না হলে কেউ এমন কথা বলতে পাড়ে?
কখনো যত্ন করে মাথায় রাখে। রাগে সেই মানুষটাই হিংস্র হয়ে উঠে।
আনিসার প্রাণে পানি নেই। গলা পর্যন্ত শুকিয়ে এসেছে। সত্যিই কি লোক টা রেগে এই এত উঁচু থেকে ফেলে দিবে? লোক টা এত ভয়ংকর? তবে লোক টা কে চিনতে তার ভুল হলো? আনিসা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আড় চোখে নিচে তাকায়। নিচ পর্যন্ত তার আড় চোখের দৃষ্টি পৌঁছায় না। মনে মনে ভাবে এই খান থেকে পরলে তার হাত থাকবে এক জায়গায়, পা থাকতে এক জায়গায়, শরীর থাকবে এক জায়গায়, আর মুণ্ড টা অন্য জায়গায় থেকে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে জিহ্ব বের করে। আদৌও মাথা ঠিক থাকবে কি না তাতে সন্দেহ আছে।
শ্রেয়ানের দৃষ্টি বেকুল আনিসার দিকে স্থির। সে বেশ বুঝতে পারছে আনিসা তাকে ভয় পাচ্ছে।
শ্রেয়ান আনিসার গাল ছেড়ে দেয়। এবার দুই হাত রাখে রেলিং এ আনিসার দুই পাশে। দুই হাত দিয়ে আনিসা কে সে বেড়াজালের মতো আটকে নেয়।
আনিসা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শ্রেয়ানের দিকে তাকাচ্ছে বারবার বুঝার চেষ্টা করছে সাইকো লোক টা কে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না। এমন মানুষ কে বুঝা বড় দায়। তারা বেশ ঠিক আর শান্ত থেকে মারাত্মক কাজ করে ফেলে। আনিসা আরো ভয় পেতে শুরু করে।
শ্রেয়ান এবার শান্ত হয়ে আনিসার দিকে তাকাল।
"আনিসা।"
শ্রেয়ানের এমন শান্ত কন্ঠ শুনে আনিসা কেঁপে উঠে। মুখে মধু অন্তরে বিষ নয় তো? এমন মিষ্টি করে ডেকে আবার ধুম করে ছাদে থেকে ফেলে দিবে নাকি? আনিসা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। আর কিছু ভাবতে পারে না।
আনিসার মুখের ভাব দেখে শ্রেয়ানে হাসি পায়। সে মনে মনে হাসে।
শ্রেয়ান আনিসার খুব কাছে যায়। বেশ অনেকটাই। আনিসার মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে নিলয়। বিড়বিড় করে বলল,
"মেয়ে মনে মনে স্থির করে নাও। শ্রেয়ানের দুনিয়াতে তোমাকে থাকতে হবে আনিসা। তোমাকে আমার হতে হবে। আমার ডাকে তোমাকে সাড়া দিতে হবে। ভেবে নিও তোমাতে রাজত্ব শ্রেয়ান চৌধুরী করবে। তোমাকে আমি পাবোই শুধু এভাবে নয়। সময় হোক। সব হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা আনিসা।"
কথা গুলি বলে শ্রেয়ান দম নিল। নিশ্বাস ছেড়ে দিল আনিসার মুখের উপর।
প্রায় ২ মিনিট পর শ্রেয়ান আনিসার থেকে ২ ফুট দূরে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
"আনিসা ঘরে যাও।"
".....
"আনিসা আমি তোমাকে ঘরে যাওয়ার কথা বললাম।"
আনিসা ঘোর নিয়ে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায়। কিন্তু শক্তি পাচ্ছে না। পা গুলি এগুতে চাইছে না। সব অসাড় লাগছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আনিসা আর দাঁড়াতে পাড়ে না। হেলে পড়ে যায় শ্রেয়ানের পিটে। শ্রেয়ান হকচকিয়ে তাড়াতাড়ি আনিসা কে হাতের মাঝে নিয়ে নেয়।
হঠাৎ পরে যাওয়ার কারণে আনিসার ওড়না বেঠিক হয়ে যায়। যা সম্পূর্ণ গলায় স্থান নেয়।
শ্রেয়ান কিছু টা অস্বস্তিতে পরে গেল। অন্য দিকে তাকিয়ে ওড়না টা ঠিক করে নেয়। তারপর আনিসার দিকে তাকায়। কি অদ্ভুত মায়া মুখে। গোধূলির আবছায়া পরছে আনিসার মুখে ঠোঁটে। এই মারাত্মক সৌন্দর্য ঝেঁকে বসেছে আনিসার উপর। শ্রেয়ান অবাক হয়ে সেই রূপের ছটা দেখছে।
আনিসা কে কোলে তুলে নেয়। শান্ত হয়ে তাকায় আনিসার দিকে।
"আনিসা তুমি পুরোটাই নেশা।"
এই বলে শ্রেয়ান আনিসা কে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে।
ডাক্তার এসে আনিসা কে দেখছে। পেছনে শ্রেয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ভয় হচ্ছে। না জানি ডাক্তার আঙ্কেল কি বলে। কেন আনিসা এত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
"শ্রেয়ান।"
"বলুন আঙ্কেল।"
"মেয়ে টা কে?"
".....
"রাস্তা থেকে এনেছো?"
"অনেক টা তাই আঙ্কেল।"
"তোমার মতো দয়ার শরীরের লোকের দ্বারা এটা ছাড়া অন্য কিছু সম্ভব নয়। যাই হোক ও খুব উইক।"
"দুই তিন বার অজ্ঞান হয়েছে এই কদিনে।"
"আসলে হয়তো অনেক কষ্ট আর চিন্তা কিংবা উত্তেজনা থেকে এমন হয়েছে। আর এমনি তেও না খাওয়ার কারণে শরীরে পুষ্টির অভাবও আছে। রক্ত মনে হয় মশাই চুষে নিতে পারবে।"
"আঙ্কেল কি কি করতে হবে।"
"যত্ন।"
".....
"শ্রেয়ান খেয়াল রাখতে হবে ওকে। ঠিক মতো খাওয়াতে হবে। এত চিন্তা বা উত্তেজিত কিংবা ভয় পেতে দেওয়া চলবে না।"
"হুম।"
"আর এই ঔষধ গুলি সময় মতো খাওয়াবে।"
"ঠিক আছে আঙ্কেল।"
"নিজের যত্ন নিও বাবা।"
"....
শ্রেয়ান মুচকি হাসে।
"চলো।"
"হুম চলুন এগিয়ে দিয়ে আসি আপনায়।"
শ্রেয়ান ডক্টর কে দিয়ে ঔষধ কিনতে যায়। আনিসা কে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। ও এখন ঘন্টা দুই এক ঘুমাবে।
.
.
.
.
.
.
.
চলবে.....