গল্পঃ--- আমার নেশা তুমি
লেখিকাঃ-- Sabriha Sadi (সাদিয়া)
পর্ব : ৯
"মনের অস্থিরতা থাকলে দুনিয়ার কোনো কাজে শান্তি পাওয়া যায় না। যার বা যে কারণে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় সেই একই বিষয় দিয়েই অস্থিরতা কাটে।"
শাওয়ারের নিচে বাথটাবে বসে আছে শ্রেয়ান। শাওয়ারের টুই টুই করা পানি শ্রেয়ানের বিশাল দেহে শোভা পাচ্ছে।
শ্রেয়ান বাথটাবে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। চোখের সামনে আনিসা। চোখ বন্ধ করে মন মস্তিষ্ক দিয়ে শ্রেয়ান আনিসা কে তার চোখে কল্পনা করছে। যখনই আনিসার ওই শুভ্র অর্ধ উন্মুক্ত পেট চোখের সামনে এলো তখনই শ্রেয়াম ধুম করে চোখের পাতা খুলে ফেলল।
মাথা ঝাঁকিয়ে বিষয়টা থেকে নিষ্কৃতি চাইছে। নিষ্কৃতি পাওয়া কি এতই সহজ?
বড় কথা শ্রেয়ানের মন আর বিশাল মস্তিষ্ক থেকে কি তা কখনোই সম্ভব?
শ্রেয়ান চুপচাপ বসে আছে বাথটাবে। বাথটাবে পানির মাঝে তার শরীরের দিকে সে নিজেই তাকিয়ে আছে। পানির মাঝে তার ধবধবে শরীরটা আর মোহনীয় লাগছে।
উপর থেকে পানি শ্রেয়ানের মাথা বেয়ে চোখে পড়ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। সেই ঝাপসা চোখেও আনিসা কে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
প্রায় দুই ঘন্টা শ্রেয়ান পানি তে বসে আছে।
শরীর তার ঠান্ডা হয়ে আছে। শরীরের সাথে মন আর মস্তিষ্ক টাও যেন ঠান্ডা হওয়ার শুরু করেছে।
এখন তার শরীর কেমন শীতল হয়ে শীত শীত লাগছে। তাই শ্রেয়ান বাথটাব ত্যাগ করে।
দুপুরে খেয়ে আনিসা শ্রেয়ানের রুমের পাশে সুইমিংপুলে চলে যায়।
শ্রেয়ানের রুমের ভেতর দিয়ে না গিয়ে সে অন্য রাস্তা দিয়ে যায়। শ্রেয়ান তখন খেয়ে ল্যাপটপে অফিসের ফাইল দেখছিল। তাই আশপাশ কিছু খেয়াল করেনি।
আনিসা সুইমিংপুলের পাশে রাখা ডিভানে বসে পরে। নীল চিকচিক করা পানির দিকে তার সূক্ষ্ম নজর।
আনিসা ভাবছে।
মা বাবা কে মিস করছে। বড্ড মনে পরছে। মায়ের সেই হাসি, আদর, আদরে ডাক, তার খেয়াল রাখা, শাসন করা সব মনে পরছে। মায়ের মুখ আনিসার চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু মন না চাইতেও পিশাচ বাবা কে মনে পরছে। যতই হোক আনিসা মানুষ কোনো যন্ত্র নয়। কিন্তু সে তার বাবা নামক পিশাচ কে মনে করতে চায় না। ভুলে যেতে চায়। যে সামান্য টাকার জন্যে নিজের রক্তের মেয়ে কে অন্য লোকের কাছে বিক্রি করে দিতে পারে আনিসার কাছে আর যাই হোক সে বাবা নয়। বাবা নামে সে কলঙ্ক। তাকে বাবা ভাবলে সব বাবা নামাক ছায়া কে অপমান করা হবে। আনিসা সেটা চায় না। তাই ওই পিশাচ কে ভুলে যেতে চায়। একদম ভুলে যেতে চায়।
অনেকক্ষণ ধরে আনিসা কথা গুলি চিন্তা করছিল।
এতক্ষণ বসে এমন মর্মান্তিক কাহিনী মনে পরে আনিসার চোখ ঝলঝল করে উঠে পানি তে। এখন আর এখানে বসে থাকতে তার ভালো লাগছে না।
আনিসা ডিভান থেকে উঠে দাঁড়ায়। অন্যমনস্ক হয়ে বুকের কষ্ট চেঁপে হাটতে থাকে।
আনিসা যেতে যেতে শ্রেয়ানের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। ঝাপসা চোখে ভালো করে দেখতেও পাচ্ছে না বেচারি।
শ্রেয়ান হঠাৎ পেছনের দরজা দিয়ে আনিসা কে আসতে দেখে অবাক হয়। ল্যাপটপ রেখে শ্রেয়ান ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ায়।
"হোয়াট হ্যাপেন আনিসা?"
"....
আনিসা কারো ডাকে থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে না।
"আনিসা তুমি পেছনে সুইমিংপুলে কি করছিলে?"
"....
আনিসা এবার আবার আগের মতো হাটা ধরে। শ্রেয়ান এগিয়ে গিয়ে আনিসার হাত ধরে পেছন থেকে।
শান্ত হয়ে বলে,
"আনিসা কি জিজ্ঞেস করলাম তোমায়? ওখানে কি করছিলে?"
"....
আনিসা পেছন ফিরে তাকায়। আনিসার চোখে পানি টুইটুম্ভুর দেখে শ্রেয়ানের খারাপ লাগছে। স্নিগ্ধ দৃষ্টি তে আনিসার দিকে তাকায়। শ্রেয়ানের চোখে তখন ছিল মায়া। আনিসা শ্রেয়ানের চোখের দিকে তাকায়।
শ্রেয়ান কিছু বুঝে উঠার আগেই আনিসা দৌড়ে গিয়ে শ্রেয়ান কে জড়িয়ে ধরে। ঝাপটে রয়েছে আনিসা শ্রেয়ানের বুকে।
শ্রেয়ান কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে তার সামনে দিয়ে এমন এক সুনামি গেল যা তার চিন্তা শক্তি লুপ করেছে। বাক শক্তি কেও হারিয়েছে সে। শুধু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আনিসা শ্রেয়ান কে আকঁড়ে শক্ত করে ধরে। বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে হুহু করে বাচ্চা দের মতো কেঁদে উঠে।
শ্রেয়ান এখনো পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হলো কিছুই বুঝতে পারছে না। শ্রেয়ান দুই হাত নিচে ঝুলিয়ে রেখেছে।
আনিসা শ্রেয়ানের শার্ট খামছে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। আনিসার নখ শ্রেয়ানের পিঠে বিঁধছে। শ্রেয়ানের ঘোর কাটে। সে বুঝতে পারছে আনিসা তাকে জড়িয়ে তার চাঁপা কষ্টের কান্না কাঁদছে। খুব কষ্টে আছে মেয়ে টা। হয়তো একটা প্রশস্ত বুক কিংবা একটা জোড়ালো কাঁধের আশা করছিল তার চাঁপা কষ্ট বের করার জন্যে।
শ্রেয়ান এক হাত আনিসার বাহুতে রাখে। অন্য হাত আনিসার মাথায়।
মাথায় হাত পেয়ে আনিসা আরো গলে যায়। যেন মোমের উপর আগুন পরেছে। যার ফলে মোম গলে গলে পড়ছে। আনিসা শ্রেয়ান কে আরো শক্তে খামছে জড়িয়ে ধরে। প্রায় আধ ঘন্টা আনিসা এই ভাবেই শ্রেয়ানের বুকে পরে কান্না করছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
"আনিসা চিল। শান্ত হোও প্লিজ।"
"...
আনিসা শ্রেয়ানকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ধরেছে। হেচকি তুলে কান্না করছে এখন।
"আনিসা প্লিজ স্টপ। কান্না বন্ধ করো।"
"আ আল্লাহ আমায় এত ক কষ্ট কেন দিল?"
"...
"আমার খুব কষ্ট অনেক ক কষ্ট। নিজের ব বাবা যার রক্তে আমি তৈরি সে কি না টাকা জন্যের তার উড়শের সন্তান কে আপনার কাছে বিক্রি করে দিল।"
".....
আনিসা শ্রেয়ানের শার্ট খামছে নিয়ে জোরে কান্না করতে থাকে। এ যেন গগন বেদ করা কান্না।
আনিসার কান্না শ্রেয়ানের জগৎ টা কে ভেঙ্গে তোলপাড় করে দিচ্ছে।
"ব বাবা না উনি একটা পিশাচ। আমি আর উনার কথা মনে করব না। উনি খুব বা বাজে লোক। আমাকে টাকার জন্যে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। উনি বাবা না। উনি নরক।"
".....
শ্রেয়ান বেশ বুঝতে পারছে আনিসা তীব্র চাঁপা কষ্ট থেকে কথা গুলি বলছে। বিষয়টা একদমই মেনে নিতে পাড়ে নি মেয়েটা।
না হলে মেয়েদের কাছে যেই বাবা কলিজা হয়। সেই বাবা কে..
"আ আপনি, আপনি আমায় কেন কিনে আনলেন? কেন কিনলেন আমাকে? কি কারণে? বাজে কাজ করাতে? আপনি কি আ আমার সাথে খুব ব বাজে কাজ করবেন? আপনি আমায় ব্যবহার করবেন না?"
আনিসা আবার জোর গলায় কান্না করে।
এই মুহূর্তে শ্রেয়ান খুব শক্ত হয়ে গেছে। খুব রাগ হচ্ছে তার রাগে ফেটে যাচ্ছে আনিসার কথায়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেঁপে ধরেছে। প্রশ্ন গুলি কঠিন অথচ উত্তর কত সহজ। প্রশ্ন গুলি সরাসরি শ্রেয়ানে লাগছে। শ্রেয়ানের শরীর জ্বলে যাচ্ছে কথা গুলি শুনে। নিহাত আনিসা কান্না করছে। না হলে নির্ঘাত আনিসার গালে ঠাটিয়ে চর দিত।
"আ আপনি আমার শরী...
"শাট আপ ননসেন্স। জাস্ট শাট আপ।"
শ্রেয়ান শরীরের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠে।
বাড়িতে অন্য কেউ থাকলে তার চিৎকারের হয়তো কানে শুনার শক্তি টা হারিয়ে ফেলত।
শ্রেয়ানের চোখ লাল হয়ে গেছে। আগুন লাল। শ্রেয়ান আনিসার দুই বাহু শক্ত করে ধরে। এতক্ষণে সে ভুলেই গেছে আনিসা কষ্টে কান্না করছিল।
আনিসার বাহু ধরে তাকে ঝাটকায় দাঁত চেঁপে বলে,
"কি বলছিস তুই? ডেমেট আন্সার মি কি বলছিস? আমি তোর শরীর.... তোকে চাইলে না আমি..."
আনিসা এখন হেলছে ডুলছে। শ্রেয়ানের দিকে ভালো করে তাকাতে পাড়েনি। হুট করে আনিসা শ্রেয়ানের বুকে হেলে পড়ে।
শ্রেয়ান ঘাবড়ে যায়। তার উইক জায়গায়ই হলো আনিসা।
শ্রেয়ান আনিসার মুখে হাত দিয়ে আনিসা কে ডাকে। আনিসার কোনো সাড়া নেই।
প্রায় এক ঘন্টা সময় এমন করে কান্নার ফলে মেয়ে টা জ্ঞান হারিয়েছে। যা শ্রেয়ানের বোধগম্য হলো।
শ্রেয়ান শান্ত হয়ে আনিসা কে কোলে তুলে নেয়। তার নরম বিছানায় আনিসা কে শুয়িয়ে দেয়। আনিসার চোখ মুখ ফুলে গেছে। চোখ নাক লাল মরিচের মতো লাল হয়ে আছে।
শ্রেয়ান বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে এক টা লম্বা নিশ্বাস নেয়।
তারপর নজর দেয় শার্টের দিকে। অর্ধেক ভিজে আছে আনিসার চোখের পানি দিয়ে। শ্রেয়ান দাঁত কিড়িমিড়ি করে তা দেখছে তার সূক্ষ্ম নজর দিয়ে।
এক টানে শ্রেয়ান নিজের শার্ট ছিঁড়ে ফেলে বেশ খানিক। শার্টের বোতাম ছিটকে এদিক ওদিক যায়। শার্ট টা গা থেকে খুলে ফেলে।
তারপর তা ছুড়ে ফেলে দিল।
বুকের মাঝে তাকিয়ে নিজের বুকেই পাঞ্চ করে খুব জোরে। তবুও মন ভরে না। দেওয়ালে নিজের হাত টা আবার ঘুষি মারে।
চোখ মুখ শক্ত করে আনিসার কাছে যায়।
টেবিল থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে তার মুখে একটু পানির ছিটে দেয়। আনিসা চোখ মেলে তাকাল। আবার চোখ নেতিয়ে আনে। হয়তো ঘুম পেয়েছে।
"খুব বেশি কান্নার পর ঘুম টা সঙ্গি হয়ে যায়।"
শ্রেয়ান ওয়াশরুমে ঢুকে। আবার শাওয়ার অন করে দেয়। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে দেওয়ালে দুই হাত রেখে।
শরীর তার আগুনের মতো জ্বলতে শুরু করেছে।
শ্রেয়ান আবারো দেড় ঘন্টার মতো শাওয়ারের পানিতে ভিজে। শরীরের জ্বালাটা একটু কমেছে। আনিসার জ্ঞান থাকলে যে শ্রেয়ান রাগে কি করত তার সাথে তা শ্রেয়ান নিজেও জানে না।
ভাগ্য ভালো আনিসা অজ্ঞান হয়েছে।
শ্রেয়ানের চোখ গুলি পানিতে লাল হয়ে আছে। আগুনের মতো চোখ গুলি জ্বলছে।
আর বেশি সময় না দিয়ে শ্রেয়ান টাওয়াল পেঁচিয়ে নেয়। এখন তার বের হতে হবে। আজ বেশি পানি তে ভিজা হয়ে গিয়েছে তার। না হয় আবার কোন বিপত্তি আসে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
চলবে....


